এভারেস্ট জয়ের ইতিহাস: ১৯৫৩ স্যার এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগে। মাউন্ট এভারেস্ট পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বত। এর উচ্চতা ৮,৮৪৮.৮৬ মিটার। অনেকেই এই চূড়া জয়ের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ১৯৫৩ সালের আগে কেউ সফল হতে পারেননি। তবে, সেই বছর এক নতুন ইতিহাস রচিত হয়। নিউজিল্যান্ডের স্যার এডমন্ড হিলারি এবং নেপালের তেনজিং নোরগে প্রথমবারের মতো মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছান। এটি ছিল এক সাহসিকতা, ধৈর্য ও নিষ্ঠার প্রতীক।
কে ছিলেন স্যার এডমন্ড হিলারি?
স্যার এডমন্ড হিলারি ছিলেন ইতিহাসের এক কিংবদন্তি পর্বতারোহী। নিউজিল্যান্ডের একজন নাগরিক ছিলেন এবং তার নাম আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয় পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করার কারণে।
উনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৯ সালের ২০ জুলাই, নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড শহরের টুয়াকাউ নামক একটি ছোট গ্রামে। তার পরিবার ছিল খুব সাধারণ। বাবা ছিলেন একজন মৌলিক স্কুলশিক্ষক এবং মা গৃহিণী। তাদের জীবন ছিল সাদামাটা, কিন্তু তারা সন্তানদের মধ্যে শিক্ষা ও মূল্যবোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করতেন।
পাহাড় তার মনকে সবসময় আকর্ষণ করত।
তিনিই বলেছিলেন—“আমি যখন প্রথম বরফে ঢাকা পর্বত দেখলাম, তখনই জানতাম একদিন আমাকে এর চূড়ায় উঠতেই হবে।”
বিদ্যালয়ে পড়ার সময় :
ক্রীড়াচর্চায় খুব ভালো ছিলেন না, তবে পাঠ্যবইয়ের বাইরে প্রাকৃতিক জীবন, অভিযাত্রা ও ঘোরাঘুরি তাকে খুব টানত।
কলেজে পড়াকালীন পর্বতারোহণ শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে নিজেকে গড়ে তোলেন একজন পরিশ্রমী, আত্মবিশ্বাসী এবং সাহসী অভিযাত্রী হিসেবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়:
হিলারি নিউজিল্যান্ড বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। সেখান থেকে ফিরে তিনি আবার পর্বতারোহণে মনোনিবেশ করেন। উনি নিউজিল্যান্ড ও ইউরোপের নানা পর্বত জয় করেন এবং নিজেকে একজন দক্ষ পর্বতারোহী হিসেবে প্রমাণ করেন।
তার এই দক্ষতাই তাকে ১৯৫৩ সালের ব্রিটিশ এভারেস্ট অভিযানের জন্য নির্বাচিত করে।
সেই অভিযানে অংশ নিয়েই তিনি নেপালের শেরপা তেনজিং নোরগের সঙ্গে ইতিহাস সৃষ্টি করেন।
নোরগে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য
তেনজিং নোরগে ছিলেন একজন সাহসী ও দক্ষ শেরপা। তিনি নেপালের খুম্বু অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন, যেটি হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত। এই অঞ্চলের মানুষদের বলা হয় ‘শেরপা’। শেরপারা পাহাড়ে চলাচল, ভার বহন এবং উচ্চতা মোকাবিলায় খুব পারদর্শী।
ছোটবেলা থেকেই পাহাড়ে ঘোরাঘুরি করতেন তেনজিং নোরগে:
নোরগের জীবনের অভিজ্ঞতা, কঠোর পরিশ্রম আর প্রাকৃতিক দক্ষতা তাকে একজন বিশেষ পর্বতারোহীতে পরিণত করে। এভারেস্ট অভিযানের অনেক আগে থেকেই তিনি হিমালয়ের বিভিন্ন উচ্চ পর্বত জয় করেছিলেন। এই অভিজ্ঞতাগুলোই তাকে হিলারির আদর্শ সহচর করে তোলে।
অভিযানের প্রস্তুতি
১৯৫৩ সালে ব্রিটিশ সরকার এক বিশেষ এভারেস্ট অভিযানের পরিকল্পনা করে।
এই অভিযানের নাম ছিল “১৯৫৩ ব্রিটিশ এভারেস্ট এক্সপিডিশন”। এই অভিযান পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অফিসার জন হান্ট। তিনি অত্যন্ত সংগঠক এবং অভিজ্ঞ নেতা ছিলেন।
প্রস্তুতি ছিল দীর্ঘ ও পরিশ্রমসাধ্য।
- একটি শক্তিশালী দল গঠন করা হয়।
- এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগে ছিলেন সেই দলের দুই প্রধান সদস্য।
- এই অভিযান ছিল খুবই জটিল ও চ্যালেঞ্জিং।
তাদের সঙ্গে ছিল:
- প্রায় ৩৫০ জন বাহক,
- ২০ টন মালামাল,
- এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, খাদ্য ও অক্সিজেন সিলিন্ডার।
এই বিশাল প্রস্তুতি থেকেই বোঝা যায়, অভিযানটি কতটা কঠিন ছিল।
আরোহণের যাত্রা শুরু
অভিযান শুরু হয় ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে।
তারা কাঠমান্ডু থেকে যাত্রা করে পাহাড়ি পথ ধরে এগিয়ে যেতে থাকেন। পথটি ছিল খুবই দুর্গম, খাড়া ও ঠাণ্ডা।
পথে নানা চ্যালেঞ্জ ছিল:
- প্রচণ্ড ঠাণ্ডা,
- তীব্র তুষারঝড়,
- খাড়া বরফে ঢাকা পথ,
- এবং অক্সিজেনের অভাব।
এই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও তারা এগিয়ে যেতে থাকেন। তারা একে একে নানা শিবির স্থাপন করে বিশ্রাম নিতেন এবং শরীরকে উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় দিতেন।
চূড়ার দিকে এগিয়ে যাওয়া
মে মাসের শেষের দিকে তারা এভারেস্টের সবচেয়ে উঁচু শিবিরে পৌঁছান, যেটিকে বলা হয় “হাই ক্যাম্প”।
২৮ মে রাত তারা সেখানে কাটান এবং পরের দিনের জন্য প্রস্তুতি নেন।
২৯ মে ভোরে তারা যাত্রা শুরু করেন চূড়ার দিকে।
আবহাওয়া ছিল অত্যন্ত ঠাণ্ডা এবং হাওয়ার বেগ ছিল তীব্র।
তবুও হিলারি ও তেনজিং সাহস নিয়ে এগিয়ে যান।
অবশেষে সফলতা – চূড়ায় পৌঁছানো
১৯৫৩ সালের ২৯ মে, সকাল ১১:৩০ মিনিট।
এই সময়টা ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
এই সময়েই স্যার এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছান।
প্রথমে পা রাখেন তেনজিং, এরপর হিলারি।
প্রায় ১৫ মিনিট সেখানে অবস্থান করেন তারা।
চূড়ায় পৌঁছে তারা
- একে অপরকে আলিঙ্গন করেন,
- ছবি তোলেন,
- এবং একটি ছোট পতাকা গেড়ে দেন।
এই মুহূর্ত ছিল মানব ইতিহাসে এক বিশাল অর্জন।
বিশ্বজুড়ে আনন্দের বন্যা
এই বিজয়ের খবর সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।
ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ হিলারিকে নাইট উপাধি দেন।
নোরগেকে নেপালে জাতীয় বীর হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
এটি ছিল শুধু একটি পর্বতজয় নয়, বরং এটি ছিল মানুষের অদম্য ইচ্ছাশক্তির প্রতীক।
সারা বিশ্বে এই জয় উদযাপন করা হয়।
বিজয়ের পেছনের কারণ
এই সফলতার পেছনে ছিল অনেক কারণ।
- হিলারি ও তেনজিং ছিলেন সাহসী, পরিশ্রমী ও নিবেদিত।
- তারা পরস্পরের উপর গভীর বিশ্বাস রাখতেন।
- দলের সদস্যদের মধ্যে চমৎকার সমন্বয় ছিল।
- তারা সবধরনের প্রতিকূলতা একসাথে মোকাবিলা করেছিলেন।
In fact, তাদের একতা ও মনোবলই ছিল এই বিজয়ের মূল চাবিকাঠি।
বিজয়ের গুরুত্ব
এ ধরনের জয় মানুষের জন্য অনেক বড় বার্তা বহন করে।
- মানুষ চাইলে অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারে, তারা এটি দেখিয়েছে।
- পর্বতারোহনের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
- অনেক তরুণ-তরুণী এরপর থেকে পাহাড় জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।
Undoubtedly, ছিল পর্বতারোহণের ইতিহাসে একটি মোড় ঘোরানো ঘটনা।
পরবর্তীতে কী হয়েছিল?
এই জয় তাদের জীবনকে পুরোপুরি বদলে দেয়।
- হিলারি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত হন।
* উনি নেপালে স্কুল, হাসপাতাল ও সেতু নির্মাণে সাহায্য করেন।
* ২০০৮ সালে তিনি মারা যান।
নোরগে শেরপা সম্প্রদায়ের উন্নয়নে কাজ করেন।
o পরবর্তীতে ‘হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট’–এর প্রধান হন।
o তেনজিং ১৯৮৬ সালে মারা যান।
শেরপাদের অবদান
হিমালয়ের শেরপা জনগোষ্ঠী এভারেস্ট জয়কে সফল করতে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছে।
- তারা অভিযানে মালামাল বহন করেন।
- কঠিন পথ পাড়ি দিতে সাহায্য করেন।
- অনেক শেরপা পেশাদার গাইড হিসেবেও কাজ করেন।
Indeed, তাদের ছাড়া এমন অভিযান কখনও সফল হতো না।
উপসংহার
Finally, স্যার এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগের মাউন্ট এভারেস্ট জয় শুধু একটি ভৌগোলিক সাফল্য নয়—এটি এক চিরন্তন প্রেরণার গল্প।
- এটি প্রমাণ করে যে সাহস, আত্মবিশ্বাস ও একতার মাধ্যমে মানুষ যেকোনো শিখর জয় করতে পারে।
- আজও তাদের নাম মানুষের মনে গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়।
আপনি যদি এমন আরও অনুপ্রেরণাদায়ক গল্প ও ইতিহাস জানতে চান, তাহলে ভিজিট করুন